বিখ্যাত কবিদের কবিতা

কাবেরী-তীরে

কর্ণাটের গঙ্গা-পূত কাবেরীর নীরে
প্রভাতে সিনানে আসে শ্যামা বেণিবর্ণা
কর্ণাটকুমারী এক,​​ নাম মেঘমালা।
সিনানের আগে নিতি কাহার উদ্দেশে
চামেলি চম্পক ফুল তরঙ্গে ভাসায়।
​​​​
ভিনদেশি বুঝি এক বণিক কুমার
হেরিয়া সে এণাক্ষীরে তরণি ভিড়ায়ে
রহে সেই ঘাটে বসি,যেতে নাহি চায়।
স্নান-স্নিগ্ধা শ্যামলীর স্নিগ্ধতর রূপে
ডুবে যায় আঁখি তার,​​ কন্ঠে ফোটে গান –
​​​​
(কর্ণাটি সামন্ত – তেতালা)
​​​​
কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা।
আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা॥
প্রভাত সিনানে আসি আলসে
কঙ্কণ তাল হানো কলসে,
খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥
দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে
তব জল ঢলঢল করুণা মাগে।
ঝিলম রেবা নদীতীরে
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥
​​​​
দ্বিধাহীনা মেঘমালা জানিত না লাজ
কুন্ঠাহীন মুখে তার ছিল না গুন্ঠন!
গান শুনি কুমারের কাছে আসি কহে –
কারে খোঁজে মেঘদূত?​​ হে বিদেশি কহো!
কহিতে কহিতে চাহি কুমারের চোখে
কী যেন হেরিয়া মুখে বেধে যায় কথা।
সেদিন প্রথম যেন আপনারে হেরি,
আপনি সে উঠিল চমকি! দেহে তার
লজ্জা আসি টেনে দিল অরুণ আঙিয়া!
ভরা ঘট লয়ে ঘরে ফিরে! নিশি রাতে
সুরের সুতায় গাঁথে কথার মুকুল।–
(নাগ স্বরাবলী – তেতালা)
​​​​
এসো চিরজনমের সাথি।
তোমারে খুঁজেছি দূর আকাশে জ্বালায়ে চাঁদের বাতি॥
খুঁজেছি প্রভাতে,​​ গোধূলি-লগনে,​​ মেঘ হয়ে আমি খুঁজেছি গগনে,
ঢেকেছে ধরণি আমার কাঁদনে অসীম তিমির রাতি॥
ফুল হয়ে আছে লতায় জড়ায়ে মোর অশ্রুর স্মৃতি
বেণুবনে বাজে বাদল নিশীথে আমারই করুণগীতি!
শত জনমের মুকুল ঝরায়ে ধরা দিতে এলে আজি মধুবায়ে
বসে আছি আশা-বকুলের ছায়ে বরণের মালা গাঁথি॥
​​ ​​​​ গান গাহি চমকিয়া ওঠে মেঘমালা।
​​ ​​​​ আপনারে ধিক্কারে সে মরিয়া মরমে –
​​ ​​​​ যদি কেহ শুনে থাকে তাহার এ গান,
​​ ​​​​ কী ভাবিবে যদি শোনে বিদেশি বণিক!
​​ ​​​​ সেদিন কাবেরীতীরে এল মেঘমালা
​​ ​​​​ বেলা করি। গাঁয়ের বধূরা একে একে
​​ ​​​​ সিনান সারিয়া ফিরে গেছে গৃহকাজে।
​​ ​​​​ বণিককুমার খোঁজে কী যেন মানিক!
​​ ​​​​ নীল শাড়ি পরি তন্বী মেঘমালা আসে
​​ ​​​​ শ্লথগতি মদালসা,​​ বিলম্বিতা বেণি।
​​ ​​​​ বণিককুমার চাহি ওপারের পানে,
​​ ​​​​ গাহে গান, –​​ না দেখার ভান করি যেন। –
​​​​
(নীলাম্বরী – তেতালা)
নীলাম্বরী শাড়ি পরি,​​ নীল যমুনায় কে যায়,​​ কে যায়,​​ কে যায়।
যেন জলে চলে থল-কমলিনী,​​ ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে চমকায় উন্মন চম্পাবনকে,
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ,​​ মাধবী,​​ অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি বনতুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে!
মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি।
তাহারই অঙ্গ-তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥
​​ ​​​​ মেঘমালা কুমারের আঁখি ফিরাইতে
​​ ​​​​ কত রূপে শব্দ করে কলসে কঙ্কণে।
​​ ​​​​ সাঁতারিয়া কাবেরীর শান্ত বক্ষ মাঝে
​​ ​​​​ অশান্ত তরঙ্গ তোলে! বণিক কুমার
​​ ​​​​ হাসি তীরে আসি কহে, ‘অঞ্চলের ফুল
​​ ​​​​ অকারণে নদীজলে ভাসাও বালিকা।
​​ ​​​​ ও ফুল আমারে দাও! দেবতা তোমার
​​ ​​​​ প্রসন্ন হবেন,​​ পাবে মনোমতো বর।’
​​ ​​​​ মেঘমালা আঁচলের ফুলগুলি লয়ে
​​ ​​​​ নদীজলে ভাসাইয়া – ঘটে জল ভরি
​​ ​​​​ চলে এল ঘরপানে,​​ চাহিল না ফিরে –
​​ ​​​​ দেখিল না কার দুটি আঁখি আঁখিনীরে
​​ ​​​​ ভরে গেছে কূলে কূলে। ঘরে ফিরে আসি
​​ ​​​​ মেঘমালা আপনার মনে মনে কাঁদে –
(নারায়ণী–আদ্ধা-কাওয়ালি)
রহি রহি কেন সেই মুখ পড়ে মনে।
ফিরায়ে দিয়াছি যারে অনাদরে অকারণে॥
উদাস চৈতালি দুপুরে মন উড়ে যেতে চায় সুদূরে
যে বনপথে সে ভিখারি-বেশে করুণা জাগায়েছিল সকরুণ নয়নে॥
তার বুকে ছিল তৃষ্ণা,​​ মোর ঘটে ছিল বারি।
পিয়াসি ফটিকজল জল পাইল না গো ঢলিয়া পড়িল হায় জলদ নেহারি॥
তার অঞ্জলির ফুল পথধূলিতে ছড়ায়েছি সেই ব্যথা নারি ভুলিতে।
অন্তরালে যারে রাখিনু চিরদিন অন্তর জুড়িয়া কেন কাঁদে সে গোপনে॥
​​ ​​ ​​ ​​​​ জলে আর যায় নাকো কর্ণাট কুমারী
​​ ​​ ​​ ​​​​ চলে গেল তরি বাহি বিদেশি কুমার
​​ ​​ ​​ ​​​​ তরণি ভরিয়া তার নয়নের নীরে!
​​ ​​ ​​ ​​​​ সেদিন নিশীথে ঝড় বাদলের খেলা,
​​ ​​ ​​ ​​​​ মেঘমালা চেয়ে আছে বাতায়ন খুলি
​​ ​​ ​​ ​​​​ কাবেরী নদীর পানে! ঘন অন্ধকারে
​​ ​​ ​​ ​​​​ বিজলি-প্রদীপ জ্বালি কোন বিরহিণী
​​ ​​ ​​ ​​​​ খুঁজে যেন তারই মতো দয়িতে তাহার।
​​ ​​ ​​ ​​​​ কাঁদিয়া কাঁদিয়া কবে পড়ে যে ঘুমায়ে,
​​ ​​ ​​ ​​​​ ঘুমায়ে স্বপন দেখে গাহিছে বিদেশি –
​​​​
(মিশ্র নারায়ণী – তেতালা)
নিশি রাতে রিম-ঝিম-ঝিম বাদল নূপুর
বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর।
দেয়া গরজে বিজলি চমকে জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে
আধ ঘুম-ঘোরে চিনিতে নারি ওরে
কে এল,​​ কে এল বলে ডাকিছে ময়ূর।
দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে আছে চেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে।
কারে দেখি আমি কারে দেখি,​​ মেঘলা আকাশ,​​ না ওই মেঘলা মেয়ে।
ধায় নদীজল মহাসাগর পানে বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে
জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে নিশিথ আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥
​​ ​​ ​​ ​​​​ মেঘমালা চমকিয়া জাগি ছুটে যায়
​​ ​​ ​​ ​​​​ পাগলিনিপ্রায় নদীতীরে। ডাকি ফেরে
​​ ​​ ​​ ​​​​ ঝড় বাদলের সাথে কন্ঠ মিশাইয়া –
​​ ​​ ​​ ​​​​ ‘কুমার! কুমার! কোথা প্রিয়তম মোর!
​​ ​​ ​​ ​​​​ লয়ে যাও মোরে তব সোনার তরিতে!’
​​ ​​ ​​ ​​​​ হারাইয়া গেল তার ক্ষীণ কন্ঠস্বর
​​ ​​ ​​ ​​​​ অনন্ত যুগের বিরহিণীর কাঁদন
​​ ​​ ​​ ​​​​ যে পথে হারায়ে যায়। আজও মোরা শুনি
​​ ​​ ​​ ​​​​ কাবেরীর জল-ছলছল অশ্রু-মাখা
​​ ​​ ​​ ​​​​ কর্ণাটিকা রাগিণীতে তাহারই বেদনা॥
(মনোরঞ্জনী – তেতালা-ঢিমা)
ওগো বৈশাখী ঝড়! লয়ে যাও অবেলায়
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ ঝরা এ মুকুল।
লয়ে যাও আমার জীবন,–​​ এই পায়ে দলা ফুল॥
ওগো নদীজল! লহো আমারে
বিরহের সেই মহা পাথারে
চাঁদের পানে চাহি যে পারাবার,
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ অনন্তকাল কাঁদে বেদনা-ব্যাকুল॥
ওরে মেঘ! মোরে সেই দেশে রেখে আয়
যে দেশে যায় না শ্যাম মথুরায়,
ভরে না বিষাদ-বিষে এ-জীবন
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ যে দেশের ক্ষণিকের ভুল॥

কবির আরো কবিতা পড়ুন

Leave a Reply

Back to top button