বিখ্যাত কবিদের কবিতা

আনোয়ার

[স্থান– প্রহরী–বেষ্টিত অন্ধকার কারাগৃহ, কনস্ট্যান্টিনোপ্‌ল্‌।
কাল–অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি।]
[চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্‌খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।
সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।
আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার ‘মা’-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, ‘হায় মাতৃহারা!’
স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।
এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘আনোয়ার!’–]
আনোয়ার! ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার!
দিলাওয়ার তুমি,​​ জোর তলওয়ার হানো,​​ আর
নেস্ত-ও-নাবুদ করো,​​ মারো যত জানোয়ার!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আফসোস্!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ বখতেরই সাফ্ দোষ,
রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ,
ভেঙে গেছে শম্‌শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আফসোস্!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আনোয়ার!
সব যদি সুম্‌সাম,​​ তুমি কেন কাঁদো আর?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আর না!–
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ দিল্ কাঁপে কার না?
তল্‌ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আর না!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আনোয়ার!
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো,​​ আর
খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আলোয়ার! জিঞ্জির–
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ পরা মোরা খিঞ্জির!
শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,–
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্‌কির!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ গর্দানে জিঞ্জির!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আনোয়ার!
দুর্বল্ এ গিদ্‌ধড়ে কেন তড়্‌পানো আর?
জোরওয়ার শের কই?​​ জের্‌বার জানোয়ার!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! মুশ্‌কিল
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ জাগা কঞ্জুশ্-দিল,
ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল!
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! মুশ্‌কিল!
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! আনোয়ার!
বেইমান মোরা,​​ নাই জান আধ-খানও আর।
কোথা খোঁজো মুস্‌লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! সব শেষ!–
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ দেহে খুন অবশেষ!–
ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !
আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ ! !
​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! সব শেষ !
​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! আনোয়ার !
জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর !
আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার !
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! –কেউ নাই !
​​ ​​ ​​ ​​​​ হাথিয়ার? –সেও নাই !
দরিয়াও থম্‌থম্ নাই তাতে ঢেউ,​​ ছাই !
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে’ও ভাই !
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! কেউ নাই !
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! আনোয়ার !
যে বলে সে মুস্‌লিম– জিভ্ ধরে টানো তার !
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! ধিক্কার !
​​ ​​ ​​ ​​​​ কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার–
তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্‌দার!
​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার! ধিক্কার!
​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! আনোয়ার!
দুনিয়াটা খুনিয়ার,​​ তবে কেন মনো আর
রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!
​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! পঞ্জায়
​​ ​​ ​​​​ বৃথা লোকে সম্‌ঝায়,
​​ ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্‌ নাচে ঝন্‌ঝায়,
খুন-খেগো তল্‌ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
​​​​ আনোয়ার ! পঞ্জায়!
​​​​ আনোয়ার ! আনোয়ার!
পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার,
ঘরে যত দুশ্‌মন,​​ পরে কেন হানো মার?–
​​​​ আনোয়ার ! এসো ভাই!
​​​​ আজ সব শেষও যাই!–
ইস্‌লামও ডুবে গেল,​​ মুক্ত স্বদেশও নাই!-
তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!
​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! এসো ভাই!!
​​ [সহসা কাফ্রি সাস্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মতো হুঙ্কার দিয়া উঠিল–​​ ‘এয়্ নৌজওয়ান,​​ হুঁশিয়ার!’​​ অধীর ক্ষোভে তিক্ত রোষে তরুণের দেহের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল! তাহার কটিদেশের,​​ গর্দানের,​​ পায়ের শৃঙ্খল খানখান হইয়া টুটিয়া গেল,​​ শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না। সে সিংহ-শাবকের মতো গর্জন করিয়া উঠিল–]
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ এয়্ খোদা! এয়্ আলি! লাও মেরি তলোয়ার!
[সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ ও কে?​​ ও কে ছল আর? ​​​​
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ না-মা,​​ মরা জানকে এ মিছে তর্‌সানো আর!
​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​ ​​​​ আনোয়ার ! আনোয়ার!!
[কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-‘আঃ-আঃ-আঃ!’
​​ ​​ ​​​​ আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে,​​ সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায়​​ ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে’​​ ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন?​​ আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে?​​ আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে,​​ আর কেন যেন মনে হইতেছে, ‘আসিবে সেদিন আসিবে!’]
সুমসাম– নিঝঝুম।
জিঞ্জির– শৃঙ্খল
খিঞ্জির– শূকর
রোণা– ক্রন্দন
জোরওয়ার– বলবান
শের– বাঘ
গিদ্‌ড়ে– শৃগাল
জোরবার– ক্ষত-বিক্ষত
কঞ্জুশ্-দিল– কৃপণ মন
বিয়াবান– মরুভূমি।
হাথিয়ার– অস্ত্র
দিক্‌দার– তিক্ত-বিরক্ত
তেগ– তলোয়ার।
তরসানো– দুঃখে দেওয়া

কবির আরো কবিতা পড়ুন

Leave a Reply

এটাও দেখুন
Close
Back to top button